জন্মনিবন্ধন আবেদন করার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া Complete process of applying for birth registration

 

 

 জন্মনিবন্ধন আবেদন করার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া

বাংলাদেশে প্রতিটি নাগরিকের পরিচয় ও অধিকার নিশ্চিত করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নথি হলো জন্মনিবন্ধন সনদ। এটি শুধু একটি সার্টিফিকেট নয়; এটি নাগরিকত্বের আনুষ্ঠানিক প্রমাণ, যা শিক্ষা, পাসপোর্ট, ভোটার আইডি, বিয়ে, সম্পত্তি হস্তান্তরসহ নানাবিধ ক্ষেত্রে অপরিহার্য। বর্তমান ডিজিটাল যুগে জন্মনিবন্ধনের আবেদন প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ ও অনলাইনভিত্তিক হয়ে গেছে। এখন ঘরে বসেই অনলাইনে আবেদন করা সম্ভব।

এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো —
জন্মনিবন্ধন কী,
কারা আবেদন করতে পারবেন,
অনলাইনে আবেদন করার নিয়ম,
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র,
ফি, সময়সীমা,
তথ্য সংশোধন প্রক্রিয়া,


 জন্মনিবন্ধন কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?

জন্মনিবন্ধন হলো কোনো ব্যক্তির জন্মের সরকারি স্বীকৃতি প্রদান প্রক্রিয়া। জন্মের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ (ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন) একজন নবজাতকের জন্মের তথ্য নিবন্ধন করে থাকে।

জন্মনিবন্ধনের গুরুত্ব

নাগরিকত্বের প্রমাণ: জন্মনিবন্ধনই একটি শিশুর প্রথম সরকারি পরিচয়পত্র।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি: স্কুলে ভর্তি হতে জন্মসনদ প্রয়োজন।
পাসপোর্ট জাতীয় পরিচয়পত্র: উভয়ের জন্যই জন্মসনদ আবশ্যক।
বিয়ে, সম্পত্তি, চাকরি বিদেশ যাত্রা: সকল ক্ষেত্রেই জন্মসনদ প্রয়োজন হয়।
সরকারি সেবা গ্রহণে: বিভিন্ন সরকারি সহায়তা বা ভাতা পেতে জন্মনিবন্ধন অপরিহার্য।

জন্মনিবন্ধন করার সময়সীমা

জন্মের পর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করা সর্বোত্তম বিনামূল্যে
তবে এই সময়সীমা পার হলে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে পরবর্তীতে নিবন্ধন করা যায়।

নিবন্ধনের সময়

         ফি (প্রযোজ্য হতে পারে)

মন্তব্য

জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে

ফ্রি

নিয়মিত নিবন্ধন

৪৫ দিন – ৫ বছর

২৫ টাকা

বিলম্বিত নিবন্ধন

৫ বছরের বেশি

৫০ টাকা

অতিবিলম্বিত নিবন্ধন

কারা জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবেন?

১. শিশুর বাবা, মা, অভিভাবক বা বৈধ প্রতিনিধি।
২. জন্ম হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ (প্রাথমিক রেজিস্ট্রেশনের জন্য)।
৩. প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি নিজেও আবেদন করতে পারেন (যদি আগে নিবন্ধন না থাকে)।

অনলাইনে জন্মনিবন্ধন আবেদন করার ধাপে ধাপে নিয়ম

বাংলাদেশে জন্মনিবন্ধন আবেদন করার সরকারি ওয়েবসাইট হলো https://bdris.gov.bd
এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সহজেই নতুন আবেদন, পুনর্মুদ্রণ বা সংশোধন করা যায়।

ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন
আপনার ব্রাউজারে লিখুন: https://bdris.gov.bd
ওয়েবসাইটটি খুললে হোমপেজে “নতুন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করুন” নামে একটি অপশন পাবেন। সেটিতে ক্লিক করুন।

জন্মস্থান নির্বাচন করুন

এখানে আপনাকে নির্বাচন করতে হবে —

  • জন্ম ইউনিয়ন পরিষদ / পৌরসভা / সিটি কর্পোরেশন
  • জেলা
  • উপজেলা

এটি নির্ধারণ করবে কোন স্থানীয় অফিস আপনার আবেদনটি প্রক্রিয়া করবে।

তথ্য পূরণ করুন

এখন একটি অনলাইন ফর্ম আসবে। এখানে ধাপে ধাপে নিচের তথ্যগুলো দিতে হবে:

. ব্যক্তিগত তথ্য:

  • নাম (বাংলা ও ইংরেজিতে)
  • জন্ম তারিখ
  • লিঙ্গ
  • জন্মস্থান

. পিতা-মাতার তথ্য:

  • বাবার নাম, জাতীয়তা, এনআইডি (যদি থাকে)
  • মায়ের নাম, জাতীয়তা, এনআইডি

. ঠিকানা:

  • বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা
  • যোগাযোগের মোবাইল নম্বর

. জন্ম সংক্রান্ত তথ্য:

  • জন্ম হাসপাতালের নাম (যদি প্রযোজ্য)
  • জন্ম রেজিস্ট্রেশন প্রমাণপত্র (যেমন: হাসপাতালের জন্ম সনদ)

সব তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করে “Submit” বাটনে ক্লিক করুন।

প্রিন্ট কপি নিন

তথ্য জমা দেওয়ার পর একটি আবেদন নম্বর (Application ID) পাওয়া যাবে। এটি সংরক্ষণ করুন।
এরপর ফর্মটি প্রিন্ট করে নিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ স্থানীয় জন্মনিবন্ধন অফিসে জমা দিন।

কাগজপত্র যাচাই

অফিসে জমা দেওয়ার পর কর্মকর্তারা আপনার তথ্য যাচাই করবেন। প্রয়োজনে তারা সাক্ষী বা অতিরিক্ত তথ্য চাইতে পারেন।

অনুমোদন সনদ সংগ্রহ

তথ্য যাচাই শেষে আপনার জন্মনিবন্ধন অনুমোদিত হলে অফিস থেকে একটি জন্মনিবন্ধন নম্বর প্রদান করা হবে।
এই নম্বর ব্যবহার করে আপনি https://bdris.gov.bd/br/search থেকে আপনার ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদ (PDF) ডাউনলোড করতে পারবেন।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

জন্মনিবন্ধন আবেদনের জন্য নিম্নোক্ত কাগজপত্র প্রস্তুত রাখুন:                           

  1. নবজাতকের জন্মপ্রমাণপত্র (হাসপাতাল/ক্লিনিক থেকে প্রদত্ত)
  2. বাবা মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি
  3. ছবি (যদি প্রয়োজন হয়)
  4. বৈধ ঠিকানার প্রমাণপত্র (যেমন বিদ্যুৎ বিল বা ভাড়া চুক্তি)
  5. পূর্বে নিবন্ধিত হলে পুরনো সনদ

অফলাইনে জন্মনিবন্ধন করার নিয়ম

যারা অনলাইন আবেদন করতে পারেন না, তারা সরাসরি নিজ এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের জন্মনিবন্ধন অফিসে গিয়ে আবেদন করতে পারেন।

প্রক্রিয়া:

  1. অফিসে গিয়ে “জন্ম নিবন্ধন আবেদন ফর্ম” সংগ্রহ করুন।
  2. ফর্মে তথ্য পূরণ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করুন।
  3. নির্ধারিত ফি প্রদান করে রসিদ সংগ্রহ করুন।
  4. নির্দিষ্ট সময় পরে সনদ সংগ্রহ করুন।

জন্মনিবন্ধন সনদ যাচাই করার নিয়ম

আপনার জন্মনিবন্ধন সনদ সঠিকভাবে নিবন্ধিত কিনা তা অনলাইনে যাচাই করা যায়।
ওয়েবসাইট: https://everify.bdris.gov.bd
যেভাবে যাচাই করবেন:

  1. জন্ম নিবন্ধন নম্বর (১৭ ডিজিট) লিখুন।
  2. জন্ম তারিখ দিন।
  3. “Search” বাটনে ক্লিক করুন।
  4. আপনার সনদের তথ্য প্রদর্শিত হবে।

জন্মনিবন্ধন সংশোধনের নিয়ম

যদি কোনো ভুল তথ্য (নাম, জন্মতারিখ, বানান ইত্যাদি) থাকে, তা সংশোধন করাও সম্ভব।

সংশোধনের ধাপ:

  1. https://bdris.gov.bd/br/application এ যান।
  2. তথ্য সংশোধনের জন্য আবেদন করুন” অপশনটি নির্বাচন করুন।
  3. পুরনো নিবন্ধন নম্বর ও জন্মতারিখ দিন।
  4. ভুল অংশটি সঠিকভাবে লিখে সংশোধনের কারণ উল্লেখ করুন।
  5. প্রমাণপত্র (যেমন স্কুল সার্টিফিকেট, এনআইডি) আপলোড করুন।
  6. নির্ধারিত ফি প্রদান করে আবেদন জমা দিন।

গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ

  1. আবেদন করার সময় বানান ও তারিখ ভালোভাবে যাচাই করুন।
  2. নাম ও জন্মতারিখ যেন এনআইডি ও পাসপোর্টের সাথে মিল থাকে।
  3. আবেদন নম্বরটি অবশ্যই সংরক্ষণ করুন।
  4. সরকারি ওয়েবসাইট ছাড়া অন্য কোনো উৎসে ব্যক্তিগত তথ্য দেবেন না।

উপসংহার

জন্মনিবন্ধন প্রতিটি নাগরিকের অধিকার এবং দায়িত্ব উভয়ই। একটি সঠিক জন্মসনদ শুধু একটি কাগজ নয় — এটি নাগরিকত্ব, পরিচয়, নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সেবার প্রবেশদ্বার। বর্তমানে অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত হওয়ায় যে কেউ ঘরে বসেই জন্মনিবন্ধন করতে পারেন। তাই আর দেরি না করে আজই https://bdris.gov.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন করুন এবং আপনার নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করুন।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post